জবি শিক্ষক অপসারণ : প্রতিশোধ না ন্যায়সঙ্গত!!
প্রসঙ্গঃ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে অপসারণ
কোটা সংস্কার আন্দোলনের রেশ কাটতে না কাটতেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। তবে এ আন্দোলন শিক্ষার্থীদের জীবন-জীবিকা বা ব্যক্তিগত স্বার্থের কোন আন্দোলন নয়। এ আন্দোলন তাঁদেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সম্মানিত শিক্ষকের জন্য আন্দোলন। সম্ভবত আমি বুঝতে শুরু করার পর শিক্ষকদের জন্য ছাত্রদের এমন বৃহৎ আন্দোলন কখনো দেখিনি। এ যুগে শিক্ষকদের জন্য ছাত্রদের আন্দোলন একজন শিক্ষকের জন্য বিশাল প্রাপ্তি। বর্তমান সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের অধিকাংশ সম্মানিত শিক্ষকরা ক্লাসে যা পড়ান তা অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মাথার উপর দিয়েই চলে যায়! শীট থেকে কপি করে বোর্ডে লিখে দেওয়াই অধিকাংশ স্যারদের শিক্ষকতা! শিক্ষার্থীরা কি বুঝলো বা কি বুঝলনা এসব নিয়ে চিন্তা স্যারেরা খুব কমই করেন। এমনও দেখেছি বা শুনেছি অনেক শিক্ষার্থী শুধুমাত্র ৭০% উপস্থিতি ঠিক রাখার জন্য বাধ্য হয়ে কিছু কিছু স্যারের ক্লাস করেন আবার এমনও স্যারের ক্লাস আছে যা করার জন্য শিক্ষার্থীরা ব্যাকুল হয়ে থাকে। ঐ স্যারের ক্লাসের সময় পিনপতন নীরবতাসহ ক্লাসরুম কাঁনায় কাঁনায় পূর্ণ থাকে। তবে দুঃখের বিষয় ক্লাসরুমে ২য় পরিস্থিতিটি সৃষ্টি করার শিক্ষক এখন খুবই কম। ছাত্ররা যত বড়ই হোক না কেন প্রতিটি ছাত্রই তার শিক্ষকদেরকে প্রচন্ড ভালোবাসতে চায়, স্যারদের কাছাকাছি থাকতে চায় কিন্তু এ ক্ষেত্রেও কিছু কিছু শিক্ষক ছাত্রদেরকে কাছে আসার সুযোগ দেয়না বরং সবসময় বিশেষ ভাব নিয়ে থাকে! আবার কিছু কিছু শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কথা শুনতে চায়, তাদের সমস্যা গুলো জানতে চায়, বুঝতে চায়। আমাদের স্যাররা জানেন কিনা জানিনা এমনই শিক্ষককে প্রতিটি শিক্ষার্থীরা কি পরিমাণ ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে তা বলে বুঝানো যাবেনা। এমন শিক্ষকদেরকে আজীবন হৃদয়ের মনিকোঠায় তারা স্থান দিয়ে থাকে। যেমনটি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সব সময় তাঁর প্রিয় আনিসুজ্জামান স্যারকে দিয়ে থাকেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সম্মানিত অধ্যাপক নাসির উদ্দিন আহমেদ স্যারের সাথে আমার ব্যক্তিগত কোন পরিচয় নেই বা আমি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রও নই। কিন্তু বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করে দেখলাম কেন শিক্ষার্থীরা স্যারকে অপসারণের প্রতিবাদে এ যুগেও বিরল ঘটনা ঘটিয়ে রাজপথে নেমেছেন। আমার কাছে বাহির থেকে প্রথমেই মনে হয়েছে নাসির স্যার নিশ্চয়ই শিক্ষার্থী বান্ধব, উনি তাঁর প্রতিটি শিক্ষার্থীকে অসম্ভব রকম ভালোবাসেন, শিক্ষার্থীদের অধিকারের বিষয়ে সবসময় সোচ্চার থাকেন। শিক্ষার্থীরা হয়তো প্রতিনিয়ত স্যারের কাছে তাদের দুঃখের কথাগুলো বলতে পারে এবং স্যার সেগুলো সম্ভবত মনোযোগ দিয়ে শুনেনও। দ্বিতীয়ত স্যার নিশ্চয়ই অনেক ভালো পড়ান, এমন স্যারের ক্লাস তাই শিক্ষার্থীরা মিস করতে চাচ্ছেনা। শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষককে ভালোবাসার আরও বহু কারন থাকলেও এ দু'টি কারণ নিশ্চয়ই মূখ্য কারন। আর এ কারনেই রাজপথে জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা।
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যতই সমালোচনা করুন না কেন সবার কাছে উনারাই দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী এবং সবাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যথেষ্ট সম্মানও করে। কিন্তু এমন সম্মানিত ব্যক্তিরা যখন গবেষণায় চুরি করে (চুরির আদর করে দেওয়া ডাকনাম চৌর্যবৃত্তি) তখন আমাদের শিক্ষার্থীদের কাছেই সবচেয়ে বেশি লজ্জা লাগে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কিছু শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এমন বেশ কিছু অভিযোগ পত্র-পত্রিকায় এসেছে। পত্রিকায় পড়ে যতটুকু জেনেছি নাসির স্যারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি অন্যের লেখা উনার নিজের গবেষণা পত্রে যুক্ত করেছেন। পত্রিকায় এও পড়েছি ঐ লেখাগুলো কোথায়ও নাকি প্রকাশিত হয়নি এবং নাসির স্যার প্রকাশিত না হওয়া এসব লেখা উনার গবেষণা থেকে বাদও দিয়েছেন। আমার এ বিষয়ে জ্ঞান না থাকলেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতো আমার মনেও প্রশ্ন জাগে যদি তিনি ঐ লেখাগুলো বাদ দিয়ে থাকেন তাহলে তো স্বাভাবিকভাবেই তিনি অভিযুক্ত নন। আবার স্যারের এক সাক্ষাৎকারে এও জানলাম স্যারকে নাকি কারণ দর্শানোর যে নোটিশ দেওয়া হয়েছে তাতে পর্যাপ্ত সময়ও দেওয়া হয়নি।
নাসির স্যারকে যে সিন্ডিকেটের সভায় অপসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সেই সভায় ঐ বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরেকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু সিন্ডিকেট ঐ শিক্ষকে যে শাস্তি দিয়েছেন তা হচ্ছে এমন, 'ঐ শিক্ষককে নিয়মিত সময়ে পদোন্নতি না দিয়ে ২ বছর পর পদোন্নতি দেওয়া হবে'। শিক্ষার্থীদের কাছে নিশ্চয়ই প্রশ্ন যেহেতু ২ বছর পর পদোন্নতি দেওয়া হবে তাহলে নিশ্চয়ই তিনি অপরাধ করেছেন। আর সেই অপরাধটি যৌন হয়রানির মতো ভয়ংকর অপরাধ, যেটি নাসির স্যারের অপরাধের চেয়ে অনেক বড় অপরাধ। কিন্তু বিধিবাম চাকরি চলে যায় নাসির স্যারদের।
কয়েকমাস আগেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একজন শিক্ষক চাকরিচ্যুত হয়েছেন কিন্তু তখন কি ঐ শিক্ষককে ফিরিয়ে আনতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমেছিল? উত্তর সরাসরি 'না' বরং তাকে চাকরিচ্যুত করার জন্য শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেছে। তাহলে নাসির স্যার কি এমন হয়ে গেলেন তাঁর জন্য শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়ে রাজপথে নামলেন! এ বিষয়টা যারা দ্রুত বুঝার চেষ্টা করবেন ততই জাতির জন্য মঙ্গল হবে। তবে কেউ কেউ আবার বলবেন নাসির স্যার গোপনে গোপনে শিক্ষার্থীদের আঁতআঁত করে আন্দোলনে রেখেছেন। তাদের উদ্যেশ্যে বলি, সাধারণ শিক্ষার্থীরা কারো প্ররোচনায় আন্দোলনে কখনো আসেনা, তাদের বিবেক যখন তাদেরকে একের পর এক ধংশন করতে থাকে তখনি তারা আর ঘরে বসে থাকতে পারেনা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদেরকে বিবেককে বিকিয়ে দিতে পারছেনা বলেই তারা আজ রাজপথে নেমেছে ।
আমাদের সমাজে একটা কথা প্রচলিত আছে "আমি যেহেতু খেতে পারবোনা, তোকেও খেতে দিবোনা"। নাসির স্যার সম্ভবত সেই কোপানলেই পড়েছেন। নাসির স্যারের সবচেয়ে বড় অপরাধ নাসির স্যার প্রথম দিন থেকেই কোটা সংস্কারের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে নিজে শামিল হয়েছেন। অপরপক্ষে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত ভিসি স্যার ৮ এপ্রিলের পূর্বে বিভিন্ন টকশোতে অন্তত কোটা ১০ শতাংশে নেমে আসুক তা চাননি। কিছুদিন আগে সারা দেশ জুড়ে আলোচিত ছিল ঢাবির একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ম্যাডাম যিনি কিনা গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি করেছেন কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে তো চাকরিচ্যুতের ঘটনা ঘটেনি। তবে কি কোটা সংস্কার আন্দোলনে সমর্থন দেওয়াই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে নাসির স্যারের?
সাধারণ শিক্ষার্থীরা সাম্প্রতিক সময়ের সবগুলো ঘটনা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নজর রেখেছে এবং গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করেছে। তারা এখন খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে তাদের স্যারকে কেন চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা আর কোন অন্যায়কে মেনে নিবেনা, যেকোন দাবি ন্যায্য হলে তা আদায় করে তবেই ঘরে ফিরবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বলবো, শিক্ষার্থীদের দাবির যৌক্তিকতা বুঝুন, নাসির স্যারকে স্বপদে দ্রুত বহাল করুন।
মামুনুর রশিদ,চবি
০৪-০৫-২০১৮