বাংলাদেশের শিক্ষা পদ্ধতি - একটি পর্যালোচনা
পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যাদের শিক্ষা পদ্ধতি পৃথিবীর অন্যতম সেরা বলে প্রমাণিত। তবে সেই প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিগুলো আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রয়োগ না করে এখনো আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই বারবার শিক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন করে চলেছি। ফলে এর বিরূপ মানসিক ও সামাজিক প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপর।
পৃথিবীর সেরা শিক্ষা পদ্ধতির দেশ হিসেবে ফিনল্যান্ড, সুইডেন, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ আরও কিছু দেশ পরিচিত। ফিনল্যান্ড ৫৪ লাখ জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত একটি দেশ। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো, এই দেশের শিক্ষা পদ্ধতিতে আমাদের দেশের মতো পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। তারপরও বিশ্বের শিক্ষার মান যাচাইয়ের অন্যতম পদ্ধতি পিআইএসএ (প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট)-এর র্যাংকিং অনুযায়ী ফিনল্যান্ড এর শিক্ষা ব্যবস্থা টানা ৯ বছর বিশ্বের সেরা ছিল। এখনো তা অব্যাহত আছে। গণিত, বিজ্ঞান ও পঠন অভ্যাসের ওপর এই মূল্যায়ন পদ্ধতিটি হয়ে থাকে। পাশাপাশি গান, ছবি আঁকা ও হাতের কাজ শিশুদের শেখানো হয়। অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, এখানে শিশুদের কোনো পাঠ্যবই নেই। এখানকার শিশুরা ৭ বছরের আগে স্কুলে যায় না। স্কুলও ৯টার আগে শুরু হয় না। স্কুলে দিনে সাধারণত ৩টি থেকে ৪টি ক্লাস হয়। একেকটি ক্লাস ৭৫ মিনিট হয়ে থাকে। প্রতি ক্লাসের পর ১৫ থেকে ২০ মিনিট বিরতি দেওয়া হয়, যাতে শিশুরা আগের ক্লাসে যা শিখেছে তা যেন চর্চা করতে পারে, হাঁটা-চলা ও পরস্পরের মধ্যে ভাব বিনিময় করে নতুন উদ্যমে পরের ক্লাসটি শুরু করতে পারে। প্রতি ক্লাসে গড়ে ১৫ থেকে ২০ জনের মতো শিক্ষার্থী থাকে। হোমওয়ার্কের পেছনেও অন্যান্য দেশের তুলনায় ফিনল্যান্ডের শিশুদের কম সময় ব্যয় করতে হয়।
এখানে পরীক্ষার পরিবর্তে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও বাস্তব জ্ঞান আহরণের বিষয়টি মুখ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। খুব কম পরিমাণে শেখানো হয়, যাতে করে শিশুরা খুব সহজে ও খেলাধুলার মাধ্যমে শিক্ষাকে আনন্দের উপাদান হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হলো এখানে যেহেতু পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থী করোরই মানসিক চাপ থাকে না, তাই শিক্ষকরা নতুন নতুন মজার মজার সৃজনশীল বিষয়ে মনোনিবেশ করতে পারেন। পরীক্ষা না নেওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে, মেধা বিকাশের সাম্য নিশ্চিত করা। আমাদের দেশ অথবা ইউরোপের অন্য কোনো দেশের তুলনায় ফিনল্যান্ডে খারাপ ছাত্র ও ভালো ছাত্রের ব্যবধান সবচেয়ে কম। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার অসম মনোভাব না থাকায় তারা পরস্পরের সঙ্গে জ্ঞানের আদান-প্রদান করে তাদের মেধার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়।
পক্ষান্তরে, আমাদের দেশে শৈশব থেকে একজন শিক্ষার্থীকে পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়িত হতে হয়। ফলে একজন কোমলমতি শিক্ষার্থীর বাবা-মা তার সন্তানকে বোঝানোর চেষ্টা করে, তাকে পরীক্ষায় ভালো করতে হলে তার ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। এতে করে শিক্ষার্থীর মনের ওপর যে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয় তা তার প্রকৃত মেধা বিকাশের সহায়ক নয়। অন্যদিকে শৈশব থেকেই একজন শিক্ষার্থী তার বন্ধুদের মানুষ হিসেবে না ভেবে তার প্রতিযোগী হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে তার মধ্যে যে আত্মকেন্দ্রিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক মনোভাব গড়ে ওঠে তা কেবল শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তার জীবনযাপন ও পরবর্তী কর্মক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে। আমাদের প্রচলিত পদ্ধতির মাধ্যমে একজন মানুষ ব্যক্তিস্বার্থ বা গোষ্ঠীস্বার্থকে সামগ্রিক স্বার্থের চেয়ে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। এর ফলে তার মধ্যে সকলকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার উদার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে না।
কেন ফিনল্যান্ডের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে গিয়ে পারস্পরিক বিশ্বাস, শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসার জায়গা থেকে শিক্ষাদান করে থাকে সে বিষয়টি নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। ফিনল্যান্ডের সমাজ কাঠামোয় শিক্ষকদের সম্মান অকল্পনীয়। সেখানকার স্কুল শিক্ষক হতে গেলে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে মাস্টার্স ডিগ্রি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, সেখানকার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রথম সারির ১০% পোস্ট গ্রাজুয়েট শিক্ষক হিসেবে চাকরির সুযোগ পান। এছাড়া শিক্ষক হতে হলে ডিগ্রির বাইরে ৫ বছরের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা থাকতে হবে, যা সরকারি ৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি থেকে নিতে হবে। শিক্ষকদের দিনে মাত্র ৪ ঘণ্টা ক্লাস নিতে হয়। এদের কাজের চাপ অনেক কম থাকলেও ঘণ্টা হিসাবে আমেরিকার চেয়ে এখানকার শিক্ষকরা বেশি বেতন পেয়ে থাকে। বিশ্বের সেরা শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম হবার পিছনে ফিনল্যান্ডের এই উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকদের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে।
আমাদের দেশের মতো জাপানে কোনো শিক্ষা বোর্ড নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার আগ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের পরীক্ষার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হয় না। এদের শিক্ষার বিভিন্ন স্তরগুলো যেমন যুগোপযোগী, তেমনি বাস্তব ও জীবনসম্পৃক্ত। এখানে শিক্ষার শুরুতে শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। এরা বিশ্বাস করে স্কুলের প্রথম ৩ বছর শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই করার উপযুক্ত সময় নয়। বরং এ সময়ে তাদের কিভাবে ছোটদের ও বড়দের সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে, ভদ্রতা, নম্রতা, শিষ্টাচার, দয়া, সত্য কথা বলা শিখতে হবে। এ বিষয়গুলো খেলাধুলা ও আনন্দের মাধ্যমে জানানো হয়। নিজের কাজ যাতে একজন শিশু নিজে করতে পারে এবং কোনো ধরনের কাজই যে ছোট নয় এ বিষয়টিও এ সময় শেখানো হয়। কেবল শেখানোর মধ্যেই এটি সীমাবদ্ধ থাকে না, এখানকার শিক্ষার্থীরা নিজেদের স্কুল প্রাঙ্গণ নিজেরাই পরিষ্কার করে। প্রকৃতিকে চেনানো ও জানানো এখানকার শিক্ষার একটি অংশ। শিক্ষা ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সামাজিক ভেদাভেদ ও বৈষম্য এখানে নেই। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্য এখনো অত্যন্ত প্রকট। এই বৈষম্যের কারণে আগামী প্রজন্মের মধ্যে সমন্বিতভাবে কাজ করে দেশের উন্নয়নে সম্পৃক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।
সেরা শিক্ষা ব্যবস্থার আরেকটি দেশ হলো সিঙ্গাপুর। এশিয়ার এই দেশটির বিজ্ঞান শিক্ষাকে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশও অনুসরণ করছে। কারণ এদের যে বিজ্ঞানের শ্রেণিকক্ষটি রয়েছে, সেটি গতানুগতিক শ্রেণিকক্ষের মতো নয়। বরং এটি দেখে মনে হবে বিজ্ঞানীদের একটি গবেষণাগার যেখানে বসে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি, কম্পিউটারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরি, সফটওয়্যার বানানো থেকে শুরু করে রোবটিক্স ও অটোমেশনের বিভিন্ন কাজ তারা হাতে-কলমে করে থাকে। একইভাবে দক্ষিণ কোরিয়া তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, সাহিত্য ও নৈতিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে জীবনসম্পৃক্ত শিক্ষার মাধ্যমে উন্নত জাতি গঠনে ভূমিকা রাখছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা আজও বাংলা ভাষাকে বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে পারিনি। এটি নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। ২০১৩ সালে ইউনিসেফ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেদারল্যান্ডের শিশুরা সবচেয়ে বেশি সুখী জীবন কাটায়। এই সুখী জীবন মানে ভোগ-বিলাসিতা নয়, বরং শিশুদের ওপর লেখাপড়ার মানসিক চাপ সৃষ্টি না করে কিভাবে বিভিন্ন কৌশলে শিক্ষার্থীর মেধাকে বাড়ানো যায় সে প্রচেষ্টা চালানো। পৃথিবীর সেরা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রথম ১০টি দেশ হলো— ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ডস, কাতার, আয়ারল্যান্ড, এস্তোনিয়া, নিউজিল্যান্ড, বার্বাডোজ ও জাপান। এই দেশগুলোর শিক্ষাপদ্ধতি বিচার-বিশ্লেষণ করে আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিকে সেরা শিক্ষা পদ্ধতিতে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তবে অন্ধ অনুকরণ নয়, আমাদের নিজস্বতা অনুযায়ী শিক্ষার প্রকৃত স্বরূপ সন্ধান করতে হবে।
লেখক :
ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।